সিরাজগঞ্জে সাংবাদিক পরিচয়ে ব্ল্যাকমেইল: মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র – Sirajganj Times

সিরাজগঞ্জে সাংবাদিক পরিচয়ে ব্ল্যাকমেইল: মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র

অভিযুক্ত জাহিদুল, লিটন ও ইয়ামিন। ছবি: কলম সৈনিক

পেশাদার সাংবাদিক না হয়েও ’সাংবাদিক’ পরিচয় ব্যবহার করে সিরাজগঞ্জে প্রতারণার ভয়ংকর জগৎ তৈরি করেছে একটি প্রতারক চক্র। সাধারণ মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে বিশাল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। গেল কয়েক মাসে এমন একাধিক ঘটনার ফিরিস্তি এসেছে গণমাধ্যমের হাতে। স্থানীয় দৈনিক কলম সৈনিক পত্রিকার মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই প্রতারক চক্রের নানা অপকর্মের চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়।

ভুক্তভোগীদের দেওয়া তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়, নাম স্বর্বস্ব একাধিক সংবাদপত্রের পরিচয় দিয়ে জাহিদুল-লিটন, ইয়ামিনসহ ৫ সদস্যের একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ অভিনব কৌশলে মানুষের সাথে প্রতারণা করে আসছে। ভুক্তভোগীরা জানান, সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থানায় মিথ্যা জিডি করে আপোশ মীমাংশার নামে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই প্রতারক চক্র।

এ সংক্রান্ত একাধিক সাধারণ ডায়েরি থেকে জানা যায়, সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে মারপিট, প্রাণনাশের হুমকি, মোটরসাইকেল ভাঙচুরসহ বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ করে থাকে চক্রটি। এসব জিডি বা অভিযোগের প্রেক্ষিতে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে ভুক্তভোগীকে ডেকে আপোশ মীমাংশার ফাঁদে ফেলে জরিমানার নামে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই চক্র। সাংবাদিক নামধারী ওই চক্রটি যে বিষয়ে সংবাদ করতে গিয়ে মার খেয়েছে, প্রাণনাশের হুমকি বা মোটরসাইকেল ভাঙচুর অভিযোগ আনা হয়, সেই বিষয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশ হতে দেখা যায়নি।

স্থানীয় সাংবাদিক ও ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই প্রতারক চক্রটি মূলধারার সাংবাদিক নয়। এরা অপকৌশলে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে। পরে সে বিষয়টি মীমাংশার জন্য ভুক্তভোগী ব্যক্তিকে জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তার মাধ্যমে ডেকে এনে অভিযোগের আপোশ মীমাংসা করতে বলা হয়। আর আপোশ মীমাংশার নামে মোটা অঙ্কের টাকায় দফারফা হয়। আপোশের লিখিত কপি থানায় দিলে ঘটনাটি মীমাংসা হয়ে যায়।

জাহিদুল গংয়ের দায়ের করা জিডি থেকে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ পৌর মালশাপাড়ার মৃত রইচ উদ্দিনের পুত্র জাহিদুল হক, তার সঙ্গী ইয়ামিন ও লিটন গত ২১ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে বিকেল সাড়ে তিনটায় এলাকাবাসীর অভিযোগের আলোকে সদর উপজেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের রূপের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রিপন এর কাছে যান। স্কুলে গিয়ে স্কুলটি তালাবদ্ধ পান। তাৎক্ষণিক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রিপনকে মোবাইল ফোন করা হয়। ফোন পেয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রিপন ৩টি মোটর সাইকেলযোগে লোকজন নিয়ে এসে হুমকি ধামকি ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে। হুমকি ধামকি ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন করায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রিপনকে বিবাদী করে সিরাজগঞ্জ সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে জাহিদুল হক। পরবর্তীতে শিক্ষক রিপন বাধ্য হয়ে তাদের সাথে মোটা টাকায় আপোশ মীমাংসা করে।

এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রিপনের কাছে জানতে চাইলে তিনি কেঁদে ফেলেন। টাকা নেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর না দিয়ে দ্রুত চলে যান। স্থানীয়রা জানান, সংবাদ সংগ্রহ করতে হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের শিকার হওয়া সাংবাদিকরা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন সংবাদ প্রকাশ না করে থানায় জিডি করেছে। এ নিয়েই প্রশ্ন থেকে যায় এরা আদৌ সাংবাদিক কিনা।

এরআগে, বহুলী ইউনিয়নের হরিণাহাটা দাখিল মাদ্রাসার সুপারের নামে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে এই চক্রটি। মাদ্রাসার সুপার ফরিদুল ইসলামের সাথে মুঠোফোনে কথা বলে জানা যায়, লিটন মাদ্রাসায় গিয়ে হট্টগোল করে। পরে শুনি আমার বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে। পরবর্তীতে ইউনিয়নের মুরুব্বিদের নিয়ে বিষয়টা মীমাংসা করা হয়। টাকা নেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে জানান কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে।

এছাড়াও আলমপুর বাজারে মাংস বিক্রেতার সাথেও এমনটি করে মীমাংসা করে নেয় বলে জানা যায়।

হরিনা দাখিল মাদ্রাসার সুপার ফরিদুল ইসলাম জানান, তারা আমাকে ব্র্যাকমেইল করেছিল। আমার নামে সিরাজগঞ্জ সদর থানায় একটি জিডি করেছিল। চাকুরি করি কোনো ঝামেলা চাই না। তাই কিছু টাকা দিয়ে তাদের সাথে মিল ভাল করে জিডিটি তুলে নিয়েছি।

রতনকান্দি ইউনিয়নের রূপের বেড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রিপন বলেন, সরকারি চাকুরি করি। পুলিশি ঝামেলা চাই না। অনেক টাকা দিয়ে বিষয়টি তাদের সাথে আপোশ হয়ে মীমাংসা করে নিয়েছি। প্রশাসনের নিকট এই প্রতারক চক্রের সদস্যদের নিকট বিচার চাই।

এসব বিষয়ে জানতে ওই চক্রের সদস্য লিটনের মুঠোফোনে ফোন দিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এই ব্যাপারে ফোনে বলার সিস্টেম নাই। আপনারা যে ব্যাপারটা নিয়ে উড়তেছেন সেটা অন্য রকম বিষয়। এত ওরা ভালো না। আমিও উড়তে চাই না। কেউ যদি আশেপাশে থেকে উড়ে সেটা আমার দোষ না। এখন উড়ে এসে কোথায় এসে পড়বে? মাটিতে পা থাকবে কি না উড়ে নিচে পড়বে কিনা এটাও তো দেখা লাগবে।

দৈনিক আলোর জগৎ এর স্টাফ রিপোটার পরিচয় দেওয়া জাহিদুল হককে ফোন দিয়ে থানায় জিডি করে ব্ল‍্যাকমেইলের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন। আজকের বসুন্ধরা পত্রিকার সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধির পরিচয় দেওয়া ইয়ামিনকে ফোন দিলে সে ফোন রিসিভ করেনি।

এ বিষয়ে ২ নং পুলিশ ফাড়ির এ.এস.আই জুয়েল বলেন, রিপন নামে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে জিডি করেছিলেন সাংবাদিকরা। বাদী সাংবাদিক হওয়ায় আমরা ওই শিক্ষককে বিষয়টি মীমাংসা করে নিতে বলেছিলাম। পরবর্তীতে তারা আপোশ মীমাংসা করে আমাদের কপি দিয়েছে। টাকা নিয়েছে কিনা সে বিষয়ে আমরা কিছু জানি না।

পেশাদার সাংবাদিকরা বলছেন, সাংবাদিকতার নাম ভাঙিয়ে এমন প্রতারণা প্রকৃত গণমাধ্যমকর্মীদের জন্যও কলঙ্কজনক। প্রশাসনের কাছে এই প্রতারক চক্রের দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

সিরাজগঞ্জ টাইমস/কলম সৈনিক/সিই